• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ২৮ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার নবান্ন সংখ্যা-১৯

গল্প : লাইফ ইজ বিউটিফুল

  রাহাতুল রাফি

০৩ মার্চ ২০২০, ১৫:২৭
গল্প
মুসলেম উদ্দিন ঝোঁপঝাড়ে এলোপাথাড়ি হাতড়ে চলেছেন (ছবি : সম্পাদিত)

‘আয়.. আয়... কিট কিট কিট.. আয়..’। মুসলেম উদ্দিন ডেকেই চলেছেন। মাগরেবের আযান হয়েছে সেই কখন। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। মুসলেম উদ্দিন ঝোঁপঝাড়ে এলোপাথাড়ি হাতড়ে চলেছেন। আর ডেকে চলেছেন, ‘আয় আয়.. কিট কিট.. আয় আয়’।

মুসলেম উদ্দিনের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। চোখেও এখন কম দেখেন। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছেন না। ঝোপঝাড়ের পরে একটু খালি জায়গা। তারপর একটা বাড়ি আছে। সুসেনের বাড়ি। সেদিকেই হয়তো গিয়েছে। সে বাড়িতে গেলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হবে। সে আশাতেই মুসলেম উদ্দিন এগিয়ে গেলেন। বাড়ির সামনে শুকনো কলাপাতার ঘের। মুসলেম উদ্দিন যেতে যেতে বাড়ির ভেতর চলে গিয়েছেন। উঠোনের মাঝ বরাবর দাড়িয়ে গলা খাকড়ি দিলেন। কেউ নাই দেখে আবারো ডেকে উঠলেন, ‘আয় আয়.. কিট কিট.. আয় আয়’। একজন বয়স্ক মহিলা ঘর থেকে বের হয়ে এগিয়ে এলেন। অপরিচিত আগন্তুকের অসময়ে আগমনের কারণ জানতে চান তিনি। ‘চাচাজি, কারে চান?’ মুসলেম উদ্দিন অস্পষ্ট স্মরে উচ্চারণ করলেন, ‘সুসেন বাড়িত আছে নি?’ ‘না, এই সময়ে তো উনি বাজারে থাকউন’। মুসলেম উদ্দিনের মুখ শুকিয়ে গেল। ‘অহো’

সুসেন পেশায় জেলে। বাজারে মাছ বিক্রি করে। আজ রবিবার। সিতারপুর বাজারের আজ হাঁটবার। সুসেনকে যারা চিনে তারা সবাই জানে এই সময় তাকে মাছ মহালে পাওয়া যাবে। মুসলেম উদ্দিনও জানতেন। কিন্তু তিনি তো অন্য কারণে এসেছেন। এই মহিলাকে কি সেই কারণ বলবেন? সবকিছু ভেবে তিনি একটু লজ্জাই পেলেন।

‘চাচাজি, কোন দরকারে আইছুইন?’ মহিলার জিজ্ঞাসু কন্ঠ। মুসলেম উদ্দিনের চটপট জবাব। ‘নাহ! কিছুনা।’

আবার পরক্ষনেই ভাবলেন, এভাবে না করে দেওয়া কি ঠিক হলো। বললেই পারতেন, যে তিনি একটা বড়ো মোরগ খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছেন। মোরগটা বাজারে এনেছিলেন বিক্রির জন্য। দামদর ভালোই চলছিল। মুসলেম উদ্দিন চেয়েছিলেন দামটা আরেকটু বাড়লেই ছেড়ে দিবেন। কিন্তু বজ্জাত মোরগ মুসলেম উদ্দিনের হাত ফসকে দৌড় দিল। যদিও পায়ে একটা দড়ি বাঁধা ছিল। বাজারের মোরগ মহালের পাশেই ঝোপঝাড়। মোরগ সেদিকেই দৌড়ে গিয়েছে। সেই থেকেই মুসলেম উদ্দিন মোরগের খোঁজে ঝোপঝাড় হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। পেলেন না। তাই ভেবেছিলেন, ঝোপঝাড়ের পরেই সুসেনের বাড়ি। মোরগ সেখানে গিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু হঠাৎ কোন অপরিচিত বাড়িতে গিয়ে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে মোরগ হারানোর ঘটনা মহিলাটিকে আর বলতে পারেন নি তিনি।

মুসলেম উদ্দিন সুসেনের বাড়ি থেকে বের হয়ে পকেটে হাত দিলেন। পকেটে একটি মাত্র দুই টাকার নোট। আর কোন টাকা নাই। অথচ আজই নগদ টাকার বড্ড দরকার। মোরগ বিক্রির টাকা দিয়ে ন্যূনতম আধাকেজি হলেও গরুর মাংস কিনে নিবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু মোরগ তো পলাতক।

মুসলেম উদ্দিনের বাড়িতে মেয়ের জামাই এসেছে। এটা মেয়ের প্রথম নাইওর। বাড়িতে মুরগি আছে। মুরগির ডিমও আছে। পাশাপাশি একটু হলেও গরুর মাংস না হলে ইজ্জত থাকে না। শুধু কি মাংস? কতো রকমের মসলা, জিরা। এখন সময় বদলেছে। সবকিছুর প্যাকেট পাওয়া যায়। সাথে সেমাই লাগবে। চিনি লাগবে। একটু চা পাতাও লাগবে। মেয়ের জামাইয়ের আবার একটু পর পর চা খাওয়ার অভ্যাস।

মুসলেম উদ্দিনের মেয়ে খুব করে বলে দিয়েছে যেন সব নিয়ে আসে। কোন কিছুই যেন ভুলে বাদ না দেয়। মেয়ে কাগজে লিখে দিতেও চেয়েছিল। কিন্তু মনে থাকবে বলে মুসলেম উদ্দিন নিজেই না করেছে। বাজারে আসার আগে মুসলেম উদ্দিনও বলে এসেছেন, এ আর এমন কী। সব নিয়ে আসবে।

তাই দুপুরের পর মেয়ে আর মেয়ের জামাই আসতেই জাল ফেলে সবচেয়ে বড়ো মোরগটা ধরেছেন। এক মোরগ বিক্রির টাকা দিয়েই সব চলে আসবে। আর মোরগটাও মহা ত্যাগর। ধরার পর থেকেই চেঁচামেচি শুরু করেছে। কখওওওকক। কখওওওওকক। মোরগের চিৎকারে বাড়ির লোকজন অতিষ্ট হওয়ার উপক্রম। অবশেষে মোরগ আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে মুসলেম উদ্দিন বাজারে চলে আসলেন।

কিন্ত এখন কি হবে? এখনো যদি খুঁজে পাওয়া যেত তবুও একটু কম দামে হলেও বিক্রি করা যেত। কিন্তু মোরগ পাওয়ার তো কোন সম্ভাবনা নাই মনে হচ্ছে। কি করবেন মুসলেম উদ্দিন। এমনিতেই রাত হয়ে গেছে। বাজার নিয়ে বাড়ি গেলে তারপর রান্না হবে। তারপর মেয়ের জামাইকে খেতে দিবেন। এতসব বাজার না নিয়ে গেলে মেয়েকে মুখ দেখাবেন কী করে। ভাবা যায় না।

মুসলেম উদ্দিনের কোন ছেলে নেই। একে একে ছয় মেয়ে। এই মেয়েটা সবার ছোট। কৃষক মুসলেম উদ্দিন অন্তত শেষে একটা ছেলের আশা করেছিলেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা শেষপর্যন্ত আর মুখ তুলে তাকাননি। মেয়েই হয়েছিল। জন্মের পর আবারো মেয়ে হয়েছে শুনে তিনি বেজায় রাগ করেছিলেন। মেয়ের মুখ পর্যন্ত দেখেননি মাসখানেক। কেউ কেউ তো আরেকটা বিয়ের পরামর্শও দিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ভেবে শেষমেষ মুসলেম উদ্দিন বিকল্প চিন্তা বাদ দেন। পৃথিবীর সমস্ত আক্ষেপ মাথায় নিয়েছেন। নিষ্টুর নিয়তি মেনে নিয়েছেন।

মেয়েটা বড়ো হতে লাগলো আর বাবার কাছে বড়ো আহ্লাদী হয়ে উঠল। মুসলেম উদ্দিনও ছোট মেয়েটার প্রতি অদ্ভূত ভালোবাসা অনুভব করলেন। অন্য মেয়েদের কাছে মুসলেম উদ্দিন ‘অত্যন্ত রাগী বাবা’ হলেও এই মেয়েটা বাবাকেই শাসিয়ে রাখতো। অন্য মেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে মোটেও ভাবেননি তিনি। কিন্তু এই মেয়েটার পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি সবসময়ই উদ্যোগী হয়েছেন। সময়মতো খাতা কলম কিনে এনেছেন। কখনো সময় করে সিধু মাস্টারের কাছে গিয়ে মেয়ের পড়াশোনার খোঁজ নিয়েছেন। প্রাইভেট পড়িয়েছেন কয়েকমাস। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল। মেট্রিক পরীক্ষার পরপরই মেয়েটার ভালো সম্মন্ধ আসল।

‘ছেরা চিটাগাং থাহে। চেহারা ছবি, দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ। সাগরের পাড়ে হোটেলে বড় চাকরি করে। কয়েকদিনের মাঝেই বাড়িত ঘরদোড় কইরে ফেলেছে। কিছু জমি জিরাতও কিনসে। তার কোন দাবী দাওয়াও নাই। তোমার ছেরি রাজরানী হয়া থাকবো।’

ঘটকের এমন বিবরণে মুসলেম উদ্দিন আর কথা বলেননি। ইচ্ছে ছিল যত কষ্টই হোক এই মেয়েটাকে আরো কিছু পড়াশোনা করাবেন। কিন্তু এমন ছেলে সে হাতছাড়া করে কিভাবে? তার উপর ছেলের কোন দাবী দাওয়াও নাই! এ যুগে এমন পাত্র পাওয়া যায় না। হয়তো উপরওয়ালাই মুখ তোলে তাকিয়েছেন। কার্তিক মাস সবে শুরু হয়েছে। ধান কাটার অনেক দেরি। এখন হাত পুরো খালি। তবুও মুসলেম উদ্দিন রাজী হয়ে যান। মেয়েটা কিছু বুঝে উঠতেই পারেনি। তার বিয়ে হয়ে যায়।

মেয়েটার বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ হয়েছে। কোন দাবী দাওয়া না থাকলেও মুসলেম উদ্দিন কোন কার্পণ্য করেননি। বাড়ির পেছনের বড়ো রেইনট্রি গাছ আর গোয়ালের ষাড় গরুটা বিক্রি করে মেয়ের বিয়ের খরচ যুগিয়েছেন। ছেলের বাড়িতে খাট, আলনা, টিভি দিয়েছেন। এছাড়াও ঘটি বাটি সহ যাবতীয় জিনিস পত্র দিয়েছেন। একটা সাইকেলও কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের বোন জামাই নিষেধ দিল। সাইকেল এখন আর যায় না। তাছাড়া সাইকেল চালাবেকে। দরকার নাই। তার বদলে ছেলেকে একটা গলার চেইন কিনে দিতে পারেন। মুসলেম উদ্দিন তাই দিয়েছেন।

বিয়ের শেষে স্বর্নের চেন কিনে দিতে গিয়েই মুসলেম উদ্দিন ঋণে ডুবলেন। এখনো স্বর্নকার নগেনের দোকানে রয়েছে বাকি পাওনা। সিদ্দিকের কাপড়ের দোকান আর মাসুদের মনিহারি দোকানে নিয়মিত বাকী পাওনার পরিমানও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা হলেই তাগাদা দিবে টাকা দেওয়ার জন্য। মেয়ের বিয়ের পর মুসলেম উদ্দিন পারতপক্ষে ওই দোকানগুলোর দিকে যান না। তাহলে আজ কী হবে?

বড় আহ্লাদী এই মেয়েটা। এতো আশা করে বলে দিয়েছে। আজ যদি একটু মাংস কিনে না নিতে পারেন তাহলে মেয়েটা তার জামাইয়ের কাছে ছোট হবে। কষ্ট পাবে। হঠাৎ নিজেকে খুব অসহায় মনে হয় তার। মুসলেম উদ্দিন মনে মনে ভাবেন- আজ যদি তার একটা ছেলে থাকতো, তাহলে মনে হয় এতটা অসহায় নিজেকে লাগতো না। ছেলেটা হয়তো পড়াশোনা করতো। পড়াশোনা শেষ করে বড়ো চাকরি করতো। মাসে মাসে মুসলেম উদ্দিনকে টাকা পাঠাতো। তাহলে আর তার কোন অভাব থাকতো না। কিন্তু কিসের কী!

মুসলেম উদ্দিন বাজারের এদিক ওদিক হেঁটে চলেছেন। হঠাৎ মনে হলো তার মাগরেবের নামাজ পড়া হয়নি। এমন তো কখনো হয় না তার। ওয়াক্তমতো নামাজ পড়েন তিনি। আজ ঝামেলায় নামাজের কথা মাথায় আসেনি। ওয়াক্ত এখনো আছে। নামাজ পড়া যাবে। ওজু করে মসজিদে ঢুকে গেলেন। নামাজে দাড়িয়ে বারবার সূরা ভুল করছেন। কী এক অশান্তির মধ্যে তিনি আছেন। নামাজ শেষে নিজের জন্য দোয়া চাইলেন। পেরেশানি দূর করে দেওয়ার ফরিয়াদ জানিয়ে দোয়া করলেন নিজের জন্য।

মসজিদ থেকে বের হতেই হঠাৎ কারো ডাকে পেছনে তাকালেন। তাকে ডাকছে হোসেন মিয়া। হোসেন মিয়ার বাজারে মনিহারি দোকান আছে। মুসলেম উদ্দিনকে দোকানে ডেকে তার বাকির খাতা দেখালেন। তিন মাস আগের তিনশত বাইশ টাকা বাকি। মুসলেম উদ্দিন বাকি টাকা কবে দিবেন? হোসেন মিয়া কি এই টাকার জন্য তার বাড়ি যাবে? টাকা দেয়ার কোন খোঁজ নাই। দেখা সাক্ষাতও নাই। হোসেন মিয়া তাহলে কি করবে? আগে বাকি নেয়ার সময় কতো কিছু বলে নিয়েছে, এখন টাকা দেয়ার বেলায় লাপাত্তা।

হোসেন মিয়ার দোকান বাকীর কথা মুসলেম উদ্দিনের মনে ছিল না? মনে ছিল। কিন্তু মুসলেম উদ্দিন করবেন কী। তিনি তো আর পেরে উঠছেন না। তাছাড়া প্রতিবছর ধানকাটা শেষ হলে হালখাতা করে সবাই। তখন সব দোকানদার হালখাতার কার্ড দিয়ে যায়। তখন হয়তো মুসলেম উদ্দিন টাকাটা দিতো। অন্তত কিছু হলেই।

এভাবেই তো তার জীবন চলে যাচ্ছে। থেমে তো নেই। আর্থিক অভাব অনটনের মাঝেই মুসলেম উদ্দিন জীবন পার করছেন। একে একে ছয়টি মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু এমন সংকটে কী কখনো তিনি এর আগে পড়েছেন? মনে পড়ে না। দেখা হলো একই গ্রামের ছফু বেপারীর সাথে। মুসলেম উদ্দিন কালই দিয়ে দিবেন, এমন আশ্বাস দিয়ে কিছু টাকা ধার চাইলেন। বেপারী পাত্তাই দিলো না। টেকা নাই। মুসলেম উদ্দিন জানে, এই কার্তিক মাসে কারো পকেটে অতিরিক্ত টাকা থাকলেও কেউ তাকে নগদ টাকা ধার দিবে না।

মুসলেম উদ্দিন আর সাত পাঁচ না ভেবে মাংসের দোকানে গেলেন। বাজারের মাছ মহালের পাশেই মন্টু কশাইয়ের মাংসের দোকান। দোকান আজ ফাঁকা। ক্রেতা নাই। মন্টু কশাই মুসলেম উদ্দিনকে দেখেই হেসে জানতে চাইলো, ‘কয় কেজি?’ মুসলেম উদ্দিন শান্ত মুখে জবাব দিলেন, ‘আধা কেজি দিলেই হবে।’ কশাইয়ের মুখের হাসি উবে গেল। পরিমান আধা কেজি বলেই হয়তো। শুকনো বিরস মুখে তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে পাল্লা বাটখারা সহকারী ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে নির্দেশ দিল, ‘ওই, এইহানে হাফ কেজি ভর। সবকিছু মিলায়া দেইখা দিস।’ মুসলেম উদ্দিন মন্টুর নিয়মিত কাস্টমার না। তার সাথে তেমন চেনা পরিচয়ও নাই। কিন্তু মেয়ের বিয়ের সময় মন্টু কশাইয়ের কাছ থেকেই বিয়ের মাংস কিনেছিলেন। সেই জন্যই কী মন্টু কশাই আগ্রহ ভরে জানতে চেয়েছিল, কয় কেজি? হতে পারে। আধা কেজি মাংস মুহুর্তেই মাপা শেষ। পেপারে মুড়ে এগিয়ে দিল ছেলেটা। ব্যাগে ভরে মুসলেম উদ্দিন ঠায় দাড়িয়ে আছেন। গলা বাড়িয়ে মুসলেম উদ্দিন কিছু বলতে চান। কী বলতে চান তিনি? ‘ভাইসাব, একটা কথা আছিল।’ মুসলেম উদ্দিনের কথায় অনুনয় সুর। ‘কি কথা?’ কশাই কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে? ‘আমার ছেরীর বিয়ার সময় আপনার কাছ থাইক্যা গোশত নিসলাম।’ ‘বাজারে তো আমি একলাই কশাই। আমার কাছ থাইক্যাই তো নিবাইন। গোশতে কোন সমস্যা হইছিন?’ ‘না ভাইসাব, তা না। সমস্যা আমার।’ মুসলেম উদ্দিন ছটপট জবাব দেন। কিন্তু কী সমস্যা তা মন্টু কশাই জানতে চায় না। তার কপালে ভাঁজ পরে গেছে। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। মুসলেম উদ্দিন আরো হাত কচলানো অবস্থায় বলা শুরু করেন। ‘ভাইসাব,একটু সমস্যায় পইড়া গেছি। টেকাডা দুই দিন বাদে দেওন লাগবো।’ ‘হালার কপালের মায়রে বাপ। এমনেই ব্যবসা নাই। তার উপরে বাকি চায়।’ মন্টু কশাই ঘাড় ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বললেও কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পান মুসলেম উদ্দিন। আরো বিগলিত হয়ে বলেন, ‘ভাইসাব আগে কোনদিন তো বাকী নিসি না। এই পয়লা বার। দুই দিন পরই টেকাডা দিয়া দিয়াম।’ মন্টু কশাই কিছু বলেন না। হা করে চেয়ে আছেন। মুসলেম উদ্দিন মনে মনে ধরে নিয়েছেন, কশাই সায় দিয়েছে। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। শাস্ত্রের কথা। মুসলেম উদ্দিন হাঁটা দিলেন। পেছন থেকে ডাক দিলো মন্টু মিয়া। ‘ওই ভাই, এইবায় আইন। পোটলাটা রাইখ্যা যান।’ তাহলে কী মাংস বাকিতে দিবে না? কাউকে কী বাকি দেয় না মন্টু কশাই? এতো অনুনয় করার পরও দিবে না? না দিক। মুসলেম উদ্দিন মাংসের পোটলাটা ব্যাগ থেকে বের করলেন। ছেলেটি ছো মেরে নিয়ে গেল সেই পোটলা। মন্টু কশাইয়ের কথা মুসলেম উদ্দিনের কানে আসলো। ‘রাইতের মধ্যে পাঁচ হাজার টেকা কিস্তি দেওন লাগবো...’

এবার কী তাহলে ফজলুর মনিহারি দোকানে যাবেন? আর তো কোন উপায় নাই। মেয়ের বিয়ের সময়েই অনেক টাকা বাকী পড়েছে। তবুও তাকে বলে কয়ে নিতে হবে। আর গিয়েই কি হবে। মাংসই যখন কেনা গেলো না। তাহলে আর মশলা কিনে কি হবে।

মুসলেম উদ্দিন বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। হাতের খালি ব্যাগটা যেন তার দিকে তাকিয়ে মশকরা করছে। কিন্তু তার পা যেন চলছে না। কোন কথা মুখে নিয়ে তিনি আজ বাড়িতে উঠবেন। কোন মিথ্যা কিছু বলবেন? বলবেন, তার পকেট মার হয়ে গেছে? অথবা পকেট থেকে টাকা হারিয়ে গেছে? আর কী বলতে পারেন। আর বললেই তার মেয়ে বিশ্বাস করবে? মেয়েকে না মানানো গেল। কিন্তু মেয়ের জামাই! তাকে কি দিয়ে পাতে দু’টো ভাত খেতে দিবেন। মেয়েটা জামাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কী করে। জামাই যখন জানবে তার শ্বশুর খালি ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে ফিরেছেন, তখন কি হবে। কী বলবেন তার মেয়েকে? আজ তিনি সত্যিকার অর্থেই পরাজিত হয়েছেন।

বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই মুসলেম উদ্দিনের কানে খিল খিল হাসির শব্দ আসে। কেমন উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত হাসি। এই সন্ধ্যা রাত্রিতে এমন উচ্চস্মরে কে হাসে! তার মেয়েই তো। মুসলেম উদ্দিন বাড়ির প্রবেশ মুখে থমকে দাড়ান। দেখেন উঠোনের এক কোণে আগুন জ্বলছে। সেই আগুন ঘিরে বসে আছে তার মেয়ে আর মেয়ের জামাই। তারা কিছু একটা করছে। মুসলেম উদ্দিনকে দেখে তার মেয়ে প্রায় দৌড়ে আসে। ‘আব্বা, এত্তো দেরি করলা কেন?’ মেয়ের আহ্লাদী কন্ঠ। কী জবাব দিবেন মুসলেম উদ্দিন। কাঁধের গামছা হাতে নিয়ে মলিন মুখটা বারকয়েক মুছলেন তিনি। যদি বলতে পারতেন ‘তোর কথা মতোন সব নিয়া আইছিরে। ব্যাগে সব আছে। দেখ। তোর মায় কই। তোর মায়েরে ডাক।’ কিন্তু বলতে পারেন নি কিছুই। মুসলেম উদ্দিনের গলা ধরে এলো। কিছুই বলতে পারলেন না। মেয়ে তাকে টেনে উঠোনের ওই কোণে আগুনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ‘দেহো আব্বা, দেহো। তোমাদের জামাইয়ের কাম দেহো।’

মুসলিম উদ্দিন অবাক হয়ে দেখছেন, ছোট গর্তে জমানো কয়লায় আগুন ধরানো হয়েছে। জামাইয়ের হাত মসলায় মাখানো। আস্ত মোরগটা কয়েক টুকরা করা। শক্ত কিছু একটাতে সেই টুকরাগুলো গেঁথে আগুনের উত্তাপ দেয়া হচ্ছে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। মুসলেম উদ্দিন তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে জামাই একি করছে। মুখ ফসকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন তিনি। ‘এইডা কী করতাসো বাবা?’ জামাই মুখ তোলে হাসলো। মেয়ের জামাইকে করা প্রশ্নের উত্তর ঝটপট মেয়েই দিল। ‘মুরগি আগুনে পুড়াইতাসে। কাবাব বানাইবো। এই পোড়া মুরগি নাহি বড়লোকেরা হাজার টেকায় কিইন্যা খায়। হাহাহা’। মুসলেম উদ্দিন অবাক হলেন। মেয়ে হাসছে। কী সুন্দর হাসি। এ বাড়ি থেকে হাসি যেন উঠেই গিয়েছিল। আজ মেয়ের মুখের হাসি দেখে মুহুর্তেই যেন তার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।

মুসলেম উদ্দিন বারান্দায় জলচৌকিতে বসে আছেন। তার স্ত্রীও পাশে বসে আছেন। গরম নাই। তারপরেও তিনি বাতাস দিচ্ছেন। উঠোনের কোণে ওরা দু’জন জলন্ত আগুনের পাশে বসে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। মুসলেম উদ্দিন জীবনে এমন সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখেননি। আর বাকি জীবনে দেখবেনও না হয়তো।

আকাশে চাঁদ উঠেছে কি না? তা আর বলতে হয়! এমন সুন্দর সময়ে আকাশে চাঁদ না উঠলে চলবে কী করে। মুসলেম উদ্দিনের এমন খুশির দিনে চাঁদ তার সমস্ত আলো উজাড় করে জোছনা ছড়িয়ে সারা পৃথিবী আলোকিত করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন : অভিনেত্রী

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড