• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

দৈনিক অধিকার নবান্ন সংখ্যা-১৯

অভিনেত্রী

মূল : শাম বারিকপুরি

  অনুবাদ : অরণ্য আপন

০২ মার্চ ২০২০, ১২:১২
প্রচ্ছদ
ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে দেখার হরেক রকম অনুভূতি হয় (ছবি : সম্পাদিত)

লোকগুলি চলে যাওয়ার পরে জামান সাহেব উঠে খাড়া হল। লোকগুলি বলতে সেই সাহেব আর তার স্ত্রী। তাজ হোটেলের ম্যানেজার সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল এবং তাদের ঘরে ঢুকে পড়ল। মাত্র তারা ঘরটা ফাঁকা করেছিল। তাদের যাওয়ার বেশি সময় হয়নি। বের হয়ে তারা একটা টেক্সি ধরল। মিস্টার আমিন টেক্সিতে চাপার আগেই মিসেস আমিন ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল। মিসেস আমিনের গোলাপি ঠোঁটের হাসি ম্যানেজারকে পেরেশান করে তুলল।

এই জুড়ি হোটেলে মাত্র তিন দিন ছিল। এই দু’জন হোটেলে ঢুকে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত। হাসাহাসি করত, দু’জন দু’জনের দিকে পলকহীন চেয়ে থাকত। প্রথম দিকে তো তারা হোটেলে কম থাকত, হোটেলে যতক্ষণ থাকত দু’জন গল্পগুজবে ডুবে থাকত, বাইরে থেকে হাসির আওয়াজ আসত। অনেক সময় তাদেরকে অন্তরঙ্গ দৃশ্যে দেখা যেত। এরকম সুখি জুড়ি খুব কমই হোটেলে দেখা যায়। হোটেলে নানান কিসিমের মানুষ আসে। ভিন্ন ভিন্ন মানুষকে দেখার হরেক রকম অনুভূতি হয়। না জানি কেন এই জুড়ি মনের কোথাও রয়ে গেল।

বেগম আমিনের এত নিষ্পাপ চেহারা যে তার মাছুম, সুন্দর চেহারা দেখলেই জামান সাহেবের দিলে ধক ধক করতে লাগত। না জানি কেন যখনই বেগম আমিনের মুখোমুখি হত একটা হাসি দিত যা জামান সাহেবের মনে ঝড় তুলত। মিসেস আমিন তার স্বামীর চেয়ে বেশি মিশুক। হলকচলক ভালো। প্রায় সব কাজে তাকেই আসতে দেখা যেত। যখন তারা খাবারটেবিলে আসত প্রায় সময় জামান সাহেবের নজরে বেগম আমিন পড়ে যেত। প্রত্যেকবার তাকে নতুন রূপে দেখতে পেত। কিতাবি চেহারা, মেঘ কালো চুলের গুছি, টানাটানা চোখ। সকাল বিকাল নতুন নতুন শাড়ি পরে সামনে আসত। এক কাপড়ে তাকে দু’বার দেখা যেত না।

জামান সাহেবের স্মৃতিতে সবকিছু জ্বলজ্বল করছে। এই ঘড়িটা সেই প্রথম দিনের মতো আজও ঘুরছে। তিন দিন আগে তারা এই হোটেলে যখন এসেছিল, ঠিক সে এই চেয়ারে বসেছিল, চেয়ারে বসে সে সিগারেট ফুঁকছিল। ছাদের দিকে ধোঁয়া ছাড়ার সময় মিসেজ আমিনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে সে মিষ্টি করে হাসি দেয়।

স্বাগতম আপনাদের। তাকে দেখার পর ভেতর থেকে কথা বলার একটা তাগাদা পেল। এরপর তার মুখে যেন খই ফোটা শুরু হল। শোনেন, আমরা লাহর শহরে নতুন এসেছি। কিছুদিন লাহরে থাকব। জামান সাহেব তাদেরকে দক্ষিণে সুন্দর একটা রুম দেয়। রুমটায় যেমন হাওয়া তেমন আলো।

বেগম আমিন বাইরে ঘুরাফেরা শেষে হোস্টেলে ঢুকে নিজ রুমে যাওয়ার সময় জামানের কাউন্টারের নিকট দাঁড়িয়ে পড়ত যতক্ষণ না মিস্টার আমিন সিঁড়ি ভেঙে ভিতরে ঢুকে যেত। সিঁড়ি ভাঙার সময় পায়ের সাথে মুখও চালু রাখত। আজ আমরা লাহরের অনেক জায়গা ঘুরলাম জামান সাহেব! সালিমার, জাহাংগির কা মাকবারা, বাগে জিন্নাহ ইত্যাদি। কখনো সে বলত, আজ নৌকায় চেপে ঘুরলাম। সে কি নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ! লাহর খুব পছন্দ হয়েছে আমাদের।

এভাবে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জানানের আন্দাজ যে তাদের বিয়ের বেশিদিন হয়নি। গায়ে এখনো বিয়ের হলুদের গন্ধ লেগে আছে। খুব বেশি হলে এক বছর বা দু’বছর কিংবা এর থেকেও কম। এখনও তাদের কোনো বাচ্চা হয়নি। তাদের আগমনে হোটেলের একটা প্রাণ এসেছে। একটা খুশির আমেজ লেগে আছে সব জায়গায়। একজন মা যেমন তার সন্তানকে আগলে রাখে ঠিক তেমনি মিসেস আনিন তার স্বামীকে যত্নে আগলে রাখতেব। এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিত না। স্বামীকে যেন প্রেমের আঁচলে বেঁধে রাখত সব সময়। তার আদর আর ভালোবাসায় মিস্টার আমিনের চেহারা খুলে গিয়েছিল। কতই না ভালোবাসে সে স্বামীকে!

এভাবে এই তিনজনের মধ্যে একটা খাচ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের সম্পর্কে লৌকিকতাও উঠে গেছিল। চল্লিশে পা দেওয়া জামানের মনে রং লেগেছিল। মিসেস আমিনকে দেখে তার মনে নতুন প্রেম পয়দা হতে লাগল। সব সময় মনের আয়নায় তার সুন্দর চেহারা ভেসে উঠত। কখনও কখনও সে দেয়ালে কান পেতে তার কথা, তার গলার আওয়াজ শুনার চেষ্টা করত। তার এই খায়েশ মাঝেমধ্যে পূরণও হত যখন মিস্টার আমিন তার বউকে নাম (গুজালা) ধরে ভালোবেসে ডাকত। গুজালা নামের উচ্চারণ শুনে তার মনে সুখের ঢেউ দুলে উঠত। সে নামের নেশায় বুঁদ হয়ে যেত।

যে ঘরে জামান সাহেব প্রবেশ করল, এই হোটেলের সব চেয়ে উমদা ঘর। লম্বা একটা নিশ্বাস নিল। একটা সুগন্ধি ঘরময় হয়ে আছে। অজানা এক সুখে তার হৃদয় ভরে গেল। সারা ঘর গুজালার গায়ের গন্ধ মেখে আছে। ম ম করছে গন্ধ। এই তিন দিনে হরিণীর খুশবু ভরা আওয়াজে সেতারায় সুর ভরে উঠেছে। ঘরের বিভিন্ন চাদরে মনকাড়া ছবি আঁকা । আচানক একটা শব্দ হল যেন।

জামান দেখতে পেল, জানলার একটা পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল। জামানের এই রকম অনুভূতি হল যে কেউ যেন তার মনের চোরকে পাকড়াও করে ফেলল। এরকম যে চার দেয়ালে, জমিনে, আসমানে সব জায়গায় গুজালার ছবি ভাসতে লাগল। এই চিন্তা করতে করতে তার মগজ ভারি হয়ে গেল।

হুটকরে তার চোখ টেবিলে গেল, এই তিন দিন ধরে ব্যবহার করা টেবিলে তার কিছু আলামত রেখে গেছে। পাউডার, চুলের তেলের খালি শিশি, চুলে চালানো চিরুনি। জামান মিস্টার আর মিসেজ আমিনের বিছানায় বসে পড়ল। চোখের সামনে তার হাসিমাখা মুখ ভেসে উঠল। তারপর সে অফিসে যাওয়ার জন্য ধড়মড় করে উঠে পড়ল। তাকে উদাস দেখাল। সে ঘর থেকে এক মন খারাপের মন নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার মুখে ঘরে কোণে একটা ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেল। হয়তো কেউ উত্তর দেবার প্রয়োজন না মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। জামান খুব আগ্রহের সহিত চিঠিটা হাতে তুলে নিল। চিঠিতে লেখা...

সে কোম্পানির প্রয়োজনে বরাবরের মতো এবারও ইংল্যান্ডে যাচ্ছে। আমি তাকে বিদায় দিয়ে তোমার কাছে আসছি যাতে আমি আর তুমি কিছুদিন কোনো হোটেলে থাকতে পারি। (গুজালা)

চিঠিটা পড়ে জামান থ মেরে গেল। তার চোখের সামনে পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগল, সে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। আচ্ছা তাহলে তারা দু’জন স্বামী স্ত্রী ছিল না!

মিসেস আমিনের অভিনেতার কোনো উত্তর ছিল না।

আরও পড়ুন : সংশয়ী মন ও মোবাইল ফোন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড