• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৭ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-১

  রহমান মৃধা

০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:৪১
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-১
ফাইজারের প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের সাবেক পরিচালক রহমান মৃধা ও তার সহধর্মিণী মারিয়া (ছবি : সংগৃহীত)

সকাল পাঁচটা বাজে। ঘুম ভেঙে গেছে। মারিয়া আমার পাশে নেই। সে আন্দামান হাসপাতালে। আমি তাকে সেখানে রেখে যখন ফিরেছি তখন রাত এগারোটার বেশি বাজে। জেসিকা হোটেলের কক্ষে একা। সে জানে না আমি বা তার মা মারিয়া কী অবস্থায় আছি! টেলিফোন শুধু তখনই কাজ করে যদি আশেপাশে ওয়াইফাই থাকে। আমরা বহু বছর পরে এক সঙ্গে ছুটিতে এসেছি। সাথে রয়েছে আমার ছেলে জনাথান, মেয়ে জেসিকা এবং সহধর্মিণী মারিয়া।

ছোটবেলার মতো করে সবাই মিলে একসঙ্গে ভ্রমণ করার ইচ্ছেটি সবার মনে জাগে এ বছরের শুরুতেই। এখন আর কেউই ছোট নেই যে আমার বা মারিয়ার ওপর নির্ভরশীল। সবারই ব্যক্তিগত মতামত রয়েছে, তারপরও আমি আবদার করেছি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যাব এবং থাকব ক্রাবি দ্বীপে।

প্রথম দিকে সবাই প্রশ্ন করেছে কেন ক্রাবি? হাজার হাজার দ্বীপ থাকতে কেন তুমি ক্রাবি পছন্দ করলে? তারপর আবার সেখানে আগেও একবার গিয়েছিলে? আমি বললাম আমরা গিয়েছি তবে তোমাদের মা যায়নি সেখানে, তাছাড়া সেখান থেকে তোমরা ইচ্ছে করলে অন্যান্য জায়গাতেও যেতে পারবে। সবাই মোটামুটি রাজি হলেও জনাথান নিজের মতো করে টিকিট কেটেছে স্টকহোম -ব্যাংকক, ব্যাংকক- ক্রাবি।

আমি, মারিয়া এবং জেসিকা চার্টার ট্রিপে করে স্টকহোম-পুকেট, পুকেট-ক্রাবি। এভাবে টিকিট কেটেছি। জনাথান উঠবে ছোট্ট একটি দ্বীপে যেখানে যেতে বোট লাগবে এবং শুধু হোটেলের অতিথি এবং কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কেউ সে দ্বীপে যেতে পারবে না। আমাদের প্যাকেট জার্নি, তার মানে যাওয়া, আসা এবং থাকা অন্তর্ভুক্ত।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-১

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সৌন্দর্য (ছবি : সংগৃহীত)

এ দিকে ছুটি দশ দিনের, তারমধ্যে দুই দিন যাওয়া, আসার মধ্যে, বাকি আট দিন আমাদের একই হোটেলে থাকতে হবে। জেসিকার চিন্তা যদি হোটেলের সবকিছু মনঃপূত না হয় তাহলে তো সর্বনাশ! আমি বললাম কীভাবে সর্বনাশ। সে উত্তরে বলল যদি আবহাওয়া খারাপ হয় তখন কোথাও ঘোরা হবে না, বাধ্য হয়ে হোটেলে সময় কাটাতে হবে, সেক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভালো এবং পরিষ্কার পরিবেশের সুইমিংপুল, জিম, সুন্দর বাগান, সাগরের দৃশ্য, খাবারের মান ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে, আর যদি আবহাওয়া ভালো খাকে তখন তো শুধু রাতে হোটেলে ঘুমোতে আসতে হবে।

প্যাকেট জার্নির এটাই একটি সমস্যা, সব ঠিকঠাক মতো করলেও ভাগ্য বলে যে কথাটি রয়েছে তাকে ভুলে গেলে চলবে না। ভাগ্য ভালো হলে সব ঠিকঠাক, তা নাহলে গেল পুরো ভ্রমণের বারোটা বেজে! যাইহোক প্রথম দর্শন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এত সবকিছু মাথায় রেখে প্লান করি এবারের ভ্রমণ সেই ফেব্রুয়ারি মাসে, বুকিং নিশ্চিত করি জুনে। ইনস্যুরেন্স থেকে শুরু করে কোভিড পাস এবং ভ্যালিড পাসপোর্টসহ ছুটি মঞ্জুর- কাজগুলো সময় মতো ম্যানেজ করা। জনাথান তার মতো করে পরিকল্পনা করেছে যেন তার টেনিস ট্যুরে বড় আকারে ব্যাঘাত না ঘটে। সে তার জাপান ট্যুর শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী স্টকহোমে আরল্যান্ডা বিমানবন্দরে আসবে, আর আমরা একই দিনে একই সময়ে বোর্ডিং শেষে হাই হ্যালো বলে যার যার প্লেনে উঠবো। আমাদের ভ্রমণের সপ্তাহ মতো বাকি। হঠাৎ পুলিশ কর্তৃপক্ষ থেকে একটি চিঠি এসেছে।

আমাদের পাসপোর্ট সময় মতো ডেলিভারি দিতে পারবে না কারণ ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সময় মতো পাসপোর্টের সবকিছু জোগাড় করতে সুইডিশ পুলিশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এত আগে সবকিছু প্লান করেছি তারপরও ঝামেলা? এদিকে সময় কম, আমার এবং মারিয়ার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে, এটা আমরা জানতাম তাই অনেক আগেই নতুন পাসপোর্টের জন্য যা যা করণীয় করেছি। পাসপোর্ট অফিসে সমস্যা চলছে গত দুইবছর ধরে তাও জানি। সুইডেন পাসপোর্ট তৈরির যে মেশিন ব্যবহার করে সেটা ফিনল্যান্ডের সঙ্গে শেয়ার করে।

পাসপোর্ট তৈরি করতে যে কাগজ ব্যবহার করে সে কাগজ মূলত তৈরি হয় রাশিয়াতে। চলছে যুদ্ধ ইউরোপে, সুইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করছে এমনকি ন্যাটো জোটে যোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। পাসপোর্ট সময় মতো ডেলিভারি না দিতে পারার কারণ জানা সত্ত্বেও পুলিশ কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করে শুধু বলে দিলাম- নাগরিকের নিরাপত্তা, অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা এই তিনটি কাজই তো করার জন্য আছো অথচ তার একটাও এখন আগের মতো হচ্ছে না কারণ কী, জানতে পারি?

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-১

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সৌন্দর্যের মাঝে রহমান মৃধা (ছবি : সংগৃহীত)

আমার প্রশ্নে চমকে গেলেও তার গ্রহণযোগ্য তেমন কিছু বলার ছিল না, শুধু বললেন অস্থায়ী একটি পাসপোর্ট এয়ারপোর্ট পুলিশ থেকে নিতে। অস্থায়ী পাসপোর্ট শুধু একবারই ব্যবহার করা যায় স্বল্প মেয়াদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে। এটা নাগরিকদের বিশেষ কারণে দেওয়া হয়ে থাকে এবং এ পাসপোর্ট ৭২ ঘণ্টার আগে পাওয়া সম্ভব নয়।

ভ্রমণের আগের দিন আমি এবং মারিয়া আমাদের বর্তমান পাসপোর্ট নিয়ে বিমানবন্দরে পুলিশ পাস-কন্ট্রোলে গেলে তারা বলল যেহেতু আমরা ডিসেম্বরের তিন তারিখে সুইডেনে ফিরব সেক্ষেত্রে অস্থায়ী পাসপোর্টের দরকার নাই। আমি বললাম তাহলে তোমার হেড অফিস, ফরেন মিনিস্ট্রি, থ্যাই অ্যাম্বেসি এমনকি সব রাষ্ট্রের হোম পেজে লেখা রয়েছে কমপক্ষে ছয় মাসের ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকতে হবে? পুলিশ বলল কিছু ব্যতিক্রম আছে যা সবাই জানে না, তাছাড়া সুইডিশ নাগরিকদের জন্য বিশেষ নিয়মকানুন রয়েছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। যাইহোক পরেরদিন সকালে বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে রওনা দিলাম থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।

বিমানবন্দরে জনাথানকে বিদায় দিলাম, সে থাই এয়ার ওয়েজে করে রওনা দিল ব্যাংককের উদ্দেশ্যে। আমরা ঘণ্টা খানেক পরে ট্যুই বিমানবন্দরে রওনা দিলাম পুকেটের উদ্দেশ্যে। একটানা ১৩ ঘণ্টা পর এসে ল্যান্ড করলাম পুকেটে। পুকেটে সকাল সবে ছয়টা বাজে মানে সুইডেনে তখন রাত বারটা।

চেকিংয়ের পর্ব শেষ হতেই দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গাইড। গাড়িতে উঠে পড়লাম ঝটপট করে। গাড়ি চলতে শুরু করল দ্বীপের মধ্য দিয়ে। দুই পাশের পরিবেশ দেখে মনের জানালা খুলে গেল, মনে হতে লাগলো এই তো সেদিন আমি তোমাকে দেখেছি। ঢাকার অদূরে মাগুরা থেকে যখন নহাটা গ্রামে ভ্যান বা রিক্সা করে গ্রামের বাড়ি যেতাম ঠিক তেমন একটি অনুভূতি এসেছিল ক্ষণিকের জন্য।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-১

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সৌন্দর্য (ছবি : সংগৃহীত)

কিছুক্ষণ যেতে দেখি রাস্তার ধারে ডাব, আম, জামরুল, থাইল্যান্ডের লিচু, নানা রকমের কলা। ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাও। গাড়ি থেমে গেল, হঠাৎ সবাই একটু অবাক হয়ে গেল! গাড়ি কেন থামালাম। পুরো গাড়িতে দশ জন মত হবে, বললাম সবাইকে একটি করে ডাব দাও। যাত্রীরা তো অবাক! চেনা নেই, জানা নেই, হুট তরে ডাব খেতে দিল, না চাইতেই! আমি শুধু ডাব নয় অনেক কিছু কিনলাম। মেয়ে এবং তার মা মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখছে, দেখছে আমার নতুন রূপ।

হঠাৎ জেসিকা প্রশ্ন করল বাবা তুমি কি তোমার নিজ দেশের কথা ভাবছো? বললাম, 'কিছুটা'। নিজেকে আবেগের থেকে সরিয়ে টেলিফোনটা ধরে কিছু ছবি কিছু ভিডিয়ো করতে করতে হোটেলে এসে চেকিংয়ের পর্ব শেষ করতেই জনাথানের টেলিফোন।

আরও পড়ুন : আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : চতুর্থ এবং শেষ পর্ব

আরও পড়ুন : আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-৩

আরও পড়ুন : আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আমদের সুখ-দুঃখের কথা : পর্ব-২

সেও উঠেছে তার হোটেলে। দুই ঘণ্টা পর একসঙ্গে লাঞ্চ করব বলে সময় এবং স্থান ধার্য করে ওয়াটসঅ্যাপে থাই ট্যুর নামে একটি গ্রুপ খুলেছে।

চলবে…

লেখক : রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট) ফাইজার, সুইডেন।

rahman.mridha@gmail.com

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড