বিশেষ প্রতিবেদক
শ্রী উত্তম কুমার রায়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নবগ্রামের বাসিন্দা। রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে মায়ের পাসপোর্ট করাতে এসেছেন। তবে আবেদনে সামান্য ভুল থাকায় জমা নেননি আবেদনপত্র জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরা। কিন্তু দালালের মাধ্যমে তার কাজটি মাত্র ১৫ মিনিটে সম্পন্ন হয়েছে।
গত রোববার সকালে মা শ্রীমতি সুমিত্রার পাসপোর্ট করাতে রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে এসে ঢাকা পোস্টকে এমন অভিজ্ঞাতার কথা জানান উত্তম কুমার রায়।
তিনি বলেন, আবেদন ফরমে একটু ভুল ছিল। ফরমের ৩৪, ৫০, ৭৫ নম্বর কলামে ‘রোড, ব্লক, সেক্টর’ এই জায়গায় ওয়ার্ড নম্বর লিখতে বলেন তারা। কলম দিয়ে ওই স্থান মার্ক করেও দেন। সেটি ঠিক করতে আবার গোদাগাড়ীতে যেতে হতো। এখানে দালালের মধ্যেমে ১৩০০ টাকা খরচ হলো। না হলে আবার বাড়ি গিয়ে হয়রানি হতে হতো। বাইরে কতজন কাগজ ঠিক করে দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তারা রাস্তার ধারের কম্পিউটারের দোকানগুলোতে নিয়ে গিয়ে ঠিক করে দেয়। তারাই ভেতরে পাস করিয়ে ফাইল জমা দিয়ে দেয়। তারপরে ফাইল নিয়ে যেতে হয় যেখানে ফিঙ্গার নিচ্ছে সেখানে।
উত্তম কুমার বলেন, আমিও গত বছরের নভেম্বরে মাসে পাসপোর্ট করে নিয়ে যাই। আমি জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল কপি বাসা থেকে নিয়ে আসিনি। তখন দালাল ধরে ১২০০ টাকা খরচ করে কাজ করিয়ে নিয়েছি। এখানে সুবিধা হচ্ছে দালালকে কোনো কাজ দিলে তারা সব ঠিকঠাক করে আবার পাসপোর্ট অফিসে জমা দিয়ে দেয়। এটা তারা কীভাবে করে তারাই জানে।
তিনি আরও বলেন, বেশি সমস্যা হয় যারা দূর থেকে বা গ্রাম থেকে আসে পাসপোর্ট করতে। তানোর, গোদাগাড়ী ও বাগমারা উপজেলার মানুষ বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। রাজশাহীর স্থানীয়রা খুব কম ভোগান্তিতে পড়ে। দূরের মানুষের তাদের সমস্যাটা ঠিক করতে বাড়িতে যেতে হবে। এতে শ্রম, সময় ও টাকা খবর হবে। আমার গোদাগাড়ীতে যাওয়া আশা করতে আড়াই থেকে তিনশ টাকা খরচ হবে। আবার একদিনের কাজ হবে না। এই কারণে আর ঘুরে বাড়িতে না গিয়ে দালাল দিয়ে ১৩০০ টাকায় কাজ করিয়ে নিয়েছি।
গত রোববার ও মঙ্গলবার রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে দালালের উপস্থিতি নেই। তবে মূল ফটকের বাইরের সড়কে সব সময় তিন থেকে চারজন দালাল ঘোরাফেরা করেন। যে সমস্ত আবেদন ভেতরে ত্রুটির কারণে বাদ দিয়ে দিচ্ছে- সেগুলো দালালরা নিয়ে দেন-দরবার করে কাজ নিচ্ছেন। বিনিময়ে তারা মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের কাছ থেকে। কাগজপত্র ঠিক করা ও পাসপোর্ট অফিস থেকে ফাইল ফেরত দেওয়ার ভোগান্তি এড়াতে দালালের দারাস্ত হচ্ছেন অনেকে।
এছাড়া অফিসের ভেতরে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছেন আনসার সদস্যরা। কাউন্টারগুলোতে আনসার সদস্যদের পাসপোর্ট ডেলিভারি করতে দেখা গেছে।
পাসপোর্ট অফিসের সামনে কয়েকজন দালালের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, যাদের কাগজপত্র ঠিক আছে তাদের সমস্যা হয় না। তাদের এমনিতেই হয়ে যায়। টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি তারা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, কই, কে টাকা নিচ্ছে আমাদের দেখান।
এছাড়া পাসপোর্ট অফিসের মূল গেটের ডান পাশে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশের ফুটপাতে চেয়ার-টেবিল নিয়ে চারটি দোকান বসানো হয়েছে। সেই দোকানগুলো থেকে পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ করা হয়। এই দোকানগুলো থেকে টার্গেট করা হয় পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। এরপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন দালালরা।
অনেক পাসপোর্ট প্রত্যাশী দালালের সহযোগিতা নেন না। তখন দালালরা পাসপোর্ট অফিসের আশপাশেই থাকেন। যদি পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের কাগজপত্রে ভুলের কারণে অফিস থেকে ফেরত দেয়। তখন তাদের টার্গেট করে দেন-দরবার করেন দালালরা। দালালরা পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের বিভিন্ন অংকের টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেন। তাদের টাকা দিয়ে অনেক পাসপোর্ট প্রত্যাশী কাজ করিয়ে নেন।
শ্রীমতি সুমিত্রার মতো একই সমস্যা শ্রীমতি জয়া উরাওয়ের। তিনি এবং তার ছেলে উৎপল রায় একই জায়গা থেকে আবেদন ফরম পূরণ করেন। শুধু নাম ছাড়া মা-ছেলের ঠিকানাসহ অন্য তথ্যগুলো একই। দুজনের কাগজপত্র জমা দিলে উৎপলের আবেদন নেওয়া হয়। কিন্তু জয়ারটা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জয়ার আবেদন ফরমে সমস্যা ধরা পড়েছে ৩৪, ৫০,৭৫ নম্বর কলামে ‘রোড, ব্লক, সেক্টর’ এই জায়গায় এলাকার নাম তালাই দেওয়া হয়েছে। তাই বাদ পড়েছে জয়ার ফরম।
উৎপল রায়ের দাবি- এমন লেখা তার ফাইলেও ছিল। কিন্তু তারটা বাদ দেয়নি। এছাড়া তার মায়ের নাগরিকত্ব সনদে ভুল ধরেন পাসপোর্ট অফিসের কর্মীরা। এ সময় পাসপোর্ট প্রত্যাশী জয়াকে বলা হয়- নাগরিকত্ব সনদ চেয়ারম্যানকে দিয়ে পূরণ করাতে হবে। এরপর দুপুর ১টা পর্যন্ত কোনোভাবে আবেদন জমা না দিতে পেরে উৎপল বাড়ি ফিরে যান। একদিন পরে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আবার এসে কাগজপত্র জমা দেন।
জয়ার ছেলে উৎপল রায় বলেন, আমার ও মায়ের কাগজে ‘রোড, ক্লক, সেক্টর’ তালাই (এলাকার নাম) দেওয়া আছে। একই কাগজ আমাদের। কাঁকনহাট থেকে কাগজপত্র অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়। রোববার (২৫ ফেব্রুয়ারি) লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দেওয়ার সময় আমার কাগজ জমা নেয়। আর মায়ের কাগজ ‘রোড, ব্লক, সেক্টর’ অংশ ঠিক করে নিয়ে আসতে বলে মার্ক করে দেয়।
উৎপল বলেন, একই কাগজ আমাদের মা-ছেলের। সবই ঠিক আছে। শুধু নামগুলো আলাদা। কাগজ হাতে পাওয়ার পরও তাই দেখেছি। স্যার বলেছে ‘রোড, ব্লক, সেক্টর’ এখানে ওয়ার্ড নম্বর দিতে হবে। আর একটা সমস্যা। নগরিকত্ব সনদ চেয়ারম্যানকে নিজ হাতে পূরণ করে দিতে হবে। না হলে হবে না। এই নগরিকত্ব সনদ সাধারণত চেয়ারম্যানের সচিব বা যারা চেয়ারম্যানের অফিসে কাজ করে তারা লেখে দেন। আর চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করেন। এটা দেখে তারা বলছে হবে না।
তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়ানোর সময় দেখেছি। লাইনে তিনটা কাগজ সাকসেস হলে দুইটা যাচ্ছে দালালের কাছে। কারণ সেই কাগজগুলোতে ভুল ধরা হচ্ছে। তারপরে মানুষ দালালের কাছে যাচ্ছে। সবই ঠিক রাখছে শুধু পাতাটা দালাল পরিবর্তন করে ভেতরে জমা দিয়ে দিচ্ছে। তার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছে।
অপরদিকে দালালকে ৯ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করেছেন রহিমা বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি রাজশাহী নগরীর বাসিন্দা হলেও কর্মসূত্রে থাকেন ঢাকায়। তাকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজশাহীতে থাকা তার ছোট বোনের স্বামী রাকিব হোসেনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে।
রাকিব হোসেন বলেন, তার (রহিমা বেগম) আগের পাসপোর্ট ছিল। এখন নতুন করে পাসপোর্ট তৈরি করতে হলো। এই কাজের জন্য দালালকে দিতে হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ টাকা। তিন মাস আগে টাকা ও কাগজপত্র জমা দিয়েছিলাম। কয়েক দিন আগে পাসপোর্ট পেলাম।
শুধু সরকারি ফি দিয়ে পাসপোর্ট করেছেন রাজু ও সবুজ। রাজু বলেন, কাগজে একটু ভুল ছিল। বাইরে যাওয়ার সময় কয়েকজন জিজ্ঞাসা করছিলেন কি সমস্যা। আমি তাদের কিছু বলিনি। সেই সমস্যা সংশোধন করে পরের দিন নিয়ে এসে কাগজ জমা দিয়েছি। সেই দিন ছবি তোলা ও ফিঙ্গার দিয়েছি।
আর সবুজ বলেন, কাগজপত্র সব ঠিক ছিল। জমা দিয়েছি। পাসপোর্ট হয়ে গেছে। কোনো সমস্যা হয়নি, কোনো দালাল ধরতেও হয়নি। অনেকের কাগজপত্রে ভুল থাকছে। তখন তারা দালালের কাছে যাচ্ছেন। তারা দালালের কাছে না গিয়ে নিজে নিজে কাগজ ঠিক করতে পারে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপপরিচালক রোজী খন্দকার বলেন, সড়কের পাশে কিছু দোকান রয়েছে। তাদের তুলে দেওয়ার জন্য চিঠি করা হয়েছে। দোকানগুলো থেকে সেবা প্রত্যাশীদের হয়রানি করা হচ্ছে। কিছু লোকের কারণে বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়া জনবলের সংকট আছে। এই কারণে আনসার সদস্যদের দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, পাসপোর্ট অফিস নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। প্রচুর মানুষ নানা প্রয়োজনে দেশের বাইরে যায়। তার বড় অংশ কর্মজীবী। ভ্রমণ, চিকিৎসাও আছে। দীর্ঘ দিনেও অভিযোগগুলোর সুরাহা হয় না। এটা বিম্ময়কর ব্যাপার। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ইচ্ছা করলেই সব কাজ করতে পারে। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ দরকার।
তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে পাসপোর্ট অফিসের জনবল বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল বাড়াতে হবে। স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের বিভিন্ন সেবার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে কোনো ভুলভ্রান্তি হলে স্বেচ্ছাসেবীদের থেকে জেনে নিতে পারেন পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। বর্তমানে তিনি সরকারি কাজে ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। কথা হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কল্যাণ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ডিসি স্যার রাজশাহীতে ফিরলে বিষয়টি জানানো হবে।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড