• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩০ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

‘কুড়িগ্রামের চাকিরপশার বিল না নদী’

  হুমায়ুন কবির সূর্য, কুড়িগ্রাম:

২৭ মার্চ ২০২৩, ১২:২৩
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার অভ্যন্তরে অবস্থিত চাকিরপশার বিলকে ঘিরে শুরু হয়েছে নানান গুঞ্জন। এটি নদী না বিল এনিয়ে চলছে পক্ষে বিপক্ষে তুমুল বিতর্কের ঝড়। পরিবেশবাদী সংগঠন রিভারনাইন পিপলস ও চাকিরপশার সুরক্ষা কমিটি এটিকে নদী ঘোষণার জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের টেকনিক্যাল কমিটি। স্থানীয় প্রভাবশালী মহল কর্তৃক দখলকৃত বিলটি যখন উদ্ধার করা যাচ্ছিল না, তখন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎপরতায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য এটি আশাব্যঞ্জক হলেও চাকিরপশার বিলকে কিভাবে নদ বা নদী বলা যায় তা নিয়ে বিতর্ক থামছেই না।

বিতর্কের মাঝেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের টেকনিক্যাল কমিটি তাদের প্রতিবেদনে চাকিরপশারকে কোথাও নদ বা নদী হিসেবে উল্লেখ করেননি। তারা এটিকে বিল হিসেবে উল্লেখ করে বিলের পানির প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য পরামর্শক হিসেবে ইটাকুড়ি বিল থেকে চাকিরপশার বিল পর্যন্ত প্রতিবন্ধক সড়কগুলোতে সেতু নির্মাণ এবং ব্যক্তি মালিকানায় দখল করা জায়গা রেকর্ড সংশোধনের মাধ্যমে পুকুর পাড় অপসারণ করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তারপরও কেউ কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিলের নাম গোপন করে এটিকে নদ বা নদী হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছেন। আদৌ যার কোনো সত্যতা, তথ্য-উপাত্ত বা ভিত্তি পাওয়া যায়নি।

সরজমিন চাকিরপশার বিলে গিয়ে দেখা যায়, এটি রাজারহাট উপজেলা শহরের এক কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থিত একটি অশ্বখুড়ের মত গোলাকার বিল বা ছড়া। মাঝখানে কৈলাশকুটি নামে একটি গ্রাম রয়েছে। এই বিল বা ছড়ার সাথে নদীর কোনো সংযোগ নেই। আশির দশকে তৎকালীন জিয়া সরকার খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে বিলের পানি সহজে নদীতে স্থানান্তর করতে একটি সংযোগ খাল তৈরী করেন। যা উলিপুরের বুড়ি তিস্তা খাল হয়ে ব্রহ্মপূত্র নদে গিয়ে পরতো। পরবর্তীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি নিষ্কাশন ও খাল খনন প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহন করে। তারা সেচ কার্যক্রম ও পানির প্রবাহ ধরে রাখার জন্য পার্শ্ববর্তী উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের গোড়াইপিয়ার নামক স্থানে একটি রেগুলেটর স্থাপন করে। পরবর্তীতে অধিগ্রহনকৃত খাল বা নালার সংস্কার কাজ না করায় এখন সেটি সরজমিনে পরিণত হয়েছে। কোথাও নালার অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চাকিরপশার বিল থেকে রেগুলেটরের দুরত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার। মাঝখানে কোন খাল বা নালার অস্থিত্ব না থাকায় চাকিরপশারকে কিভাবে নদ বা নদী বলা হচ্চে এনিয়ে হতবাক এলাকার মানুষ।

তথাকথিত চাকিরপশার নদের উৎপত্তিস্থল বলা হচ্ছে ৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ইটাকুড়ি বিল থেকে। ইটাকুরিও একটি বদ্ধ জলাশয়, বিল বা নালা। এর সাথে তিস্তা নদীর কোন সংযোগ নেই। এই বদ্ধ বিল বা জলাশয় থেকে নদ বা নদী কিভাবে উৎপত্তি হল তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ফলে রিভারনাইন পিপলস’র নদী নিয়ে আন্দোলন কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের টেকনিক্যাল টিমের সাথে যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, নদী রক্ষা কমিশন থেকে যে টেকনিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছিল তাদের কর্মকান্ড ছিল একপেশে। ফলে টেকনিক্যাল টিমের সাথে ভিন্নমত পোষন করে তাতে স্বাক্ষর করেননি কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও রাজারহাট উপজেলার ভূমি কর্মকর্তা।

এদিকে রাজারহাট ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুসারে দেখা যাচ্ছে, রাজারহাট ও চাকিরপশার ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত চাকিরপশার বিলটি বদ্ধ জলাশয় হিসেবে তৎকালীন ১৯৪০ সালে ভারত স¤্রাটের নামে ‘বিল শ্রেণি’ হিসেবে সিএস রেকর্ডে নথিভূক্ত হয়। ৫টি মৌজায় ৬টি খতিয়ানে মোট ২৫৯.৪৫ একর জমি নথিভূক্ত করা হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে রংপুর কালেক্টরের নামে ১নং খাস খতিয়ানে ৫টি মৌজায় ৫টি খতিয়ানে ১৮৪.০৮ একর জমি বিল শ্রেণি হিসেবে রেকর্ডভূক্ত করা হয় ১৯৬২ সালে। এরপর নব্বই দশকের সময় ভূমিখোরদের আগ্রাসনে কমতে থাকে সরকারি নথিভূক্ত জমি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সিএসএ জমি রেকর্ড করা হয় ২৬৫,৩১ একর, এসএ রেকর্ডে ১৮৪.০৮ একর এবং আরএস রেকর্ডে ৩৬.২৮ একর। অসাধু ব্যক্তিরা কতোটা বেপরোয়া হলে এমন হতে পারে সেটি এখানকার জমির সর্বশেষ অবস্থান দেখলে বোঝা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে বিলগুলো গ্রাস করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে তারা আসলে কার পক্ষে কাজ করেছে।

নথি ঘেটে ৫টি মৌজায় কিভাবে বিলগুলো গ্রাস হয়েছে তার চিত্র দেখে চমকে উঠতে হয়। চাকিরপশার তালুকে সর্বশেষ রেকর্ড করা হয়েছিল ২০.৩৩ একর জমি। এখন সরকারের ভাগে রয়েছে মাত্র ৫.১১ একর জমি। ভূমি দস্যুদের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে ১৫.২২ একর জমি । নাফাডাঙ্গা বিলের ৮৮.৫৩ একর জমির মধ্যে বন্দোবস্ত ও ব্যক্তিগত মামলায় লোপাট হয়ে গেছে ২৪,০৫ একর জমি। একই অবস্থা চান্দামারী বিলের ৮৩.৭৯ একর জমি। এই বিলের ৪২,৬৭ একর ভূমি সরকারি ফাইল থেকে গায়েব হয়ে ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে। সদাগড় বিলের ২৩.৫৩ একর জমির মধ্যে ১৬.৭৩ একর রেকর্ডভূক্ত হয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। সর্বশেষ খালিশা বিলের ৮৩.৭৯ একর জমির মধ্যে এখন বন্দোবস্ত ও ব্যক্তিগত মামলায় ৪৯.১৩ লোপাট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে রাজারহাট ভূমি অফিসের বক্তব্য, সরকার থেকে মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তির নামে রেকর্ডকৃত রেকর্ড সংশোধনের জন্য রংপুর জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে আপত্তি দায়ের করা হয়েছে এবং আদালতের ডিগ্রীর বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করার কার্যক্রম চলমান।

দীর্ঘ সময়ে এসএ ও আরএস’ মাধ্যমে কতিপয় অসাধূ ব্যক্তি এক হোল্ডিং’র খাসকৃত জমি এখন ১১৬টি হোল্ডিং-এ পরিণত করেছে। অবৈধ কাগজপত্র তৈরী করে তারা ষাটের দশক থেকে এসব জমি ভোগদখল করে আসছে। আগে বাপ-দাদারা জমি ভোগ করেছে, এখন করছে সন্তানরা। হচ্ছে হাত বদল। সারা বছর ধরে পানির প্রবাহ থাকা বিলকে তারা শ্রেণি পরিবর্তন করে জলাশয় থেকে কাগজে কলমে দোলা শ্রেণিতে পরিণত করেছে। এরফলে উজানের শত শত কৃষকের একরের পর একর ফসলী জমিন বর্ষায় জলাবদ্ধতায় খালি ফেলে রাখতে হচ্ছে। কষ্ট আর কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও দেখার যেন কেউ নেই। চাকিরপশার বিলের প্রবাহ বন্ধ করে পুকুরের মত পাড় দিয়ে ছোট ছোট ডোবায় ভাগ- বাটোয়ারা করে তারা ব্যক্তিগতভাবে মাছ চাষ করছে। এরফলে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। উজানের পানি এখন আর এদিক দিয়ে বের হচ্ছে না। নিষ্ঠুরভাবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর দেয়াল তুলে দিয়েছে অবৈধ দলখদাররা। সরকারের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বেপরোয়া কর্মকান্ডের ফলে চাকিরপশার বিল হারিয়ে ফেলেছে তার শারীরিক কাঠামো। শীর্ণকায় হয়েছে তার যৌবন। বৃত্তবানদের কাছ থেকে মালিকানা হারিয়েছে সাধারণ মৎসজীবীরা। পানিতে নামলেই লাঠিয়াল বাহিনী তেড়ে আসছে। ভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে উচ্ছেদে যেতে পারছে না প্রশাসন।

সমাজকর্মী ও হরিশ্বর তালুক উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ মোল্লা (৭৫) জানান, আমরা কখনো দেখিনি এটা নদী। জন্মের পর থেকে রাজারহাটবাসী এটাকে বিল হিসেবে দেখে আসছে। জোড় করে বিলকে নদী বলা যায় না। যে বিলের মাছ খেয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি।

চাকিরপশার কিশামত পূণকর গ্রামের মৃত: টাঙ্গার মামুদের পূত্র আবু হানিফ (৭২) বলেন, হামার বাপ-দাদারা বৃটিশ আমল থাকি এটা বিল বলি জানছে। মাঝোত নদী নিয়ে আন্দোলন হইলো। এতে হামার কি লাভ হইল। আগোত হামরা মাছ মারি খাছি। এ্যালা বিলোত নামবেরে দেয় না। বড়লোকেরা বিলটা খায়া ফেলাল বাহে। বাকী সরকারি যে বিলকোনা আছে তাকে লীগের ছওয়া পওয়া খাবার নাগছে। হামরাগুলা সাধারণ মানুষ মাছ খাবার পাই না।

তথ্যানুসন্ধান করে দেখা গেল, এই বিলের বড় একটি অংশ সাবেক চেয়ারম্যান পনির উদ্দিন আহমেদের সন্তান মিন্টু ও বাবলুরা দখল করে আছে প্রায় ৬একর জমি। সাবেক ইসমাইল চেয়ারম্যানের নাতি টিটুরা দখল করে আছে ১০ একর জমি এবং আব্দুল্লাহ সরওয়ার্দির ছেলে বর্তমান রাজারহাট উপজেলা চেয়ারম্যান বাপ্পীরা দখল করে আছে ৬ একর জমি। এছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতা আবু বকর ১২ একর জমি দখলে নিয়ে ফারুক নামে একজনকে লিজ দিয়েছে। অপরদিকে পাঠানপাড়া ঈদগাহ মাঠ এলাকার সরকারি লিজকৃত জমি ভোগ করছে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আবুনুর গ্রুপের মোশাররফ, রনিসহ বেশ কয়েকজন। ব্র্যাক অফিস থেকে চান্দামারী রামশিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি লিজকৃত জমি ভোগদখল করছে বাপ্পী গ্রুপের রিপন, মুন, রাইসুলসহ বেশ কয়েকজন। এখানে বছরের পর বছর ধরে যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা এখন মাছ বিহীন জীবন যাপন করছে।

মাজাপাড়া গ্রামের নুর ইসলাম (৪৫) জানান, এই চাকিরপশার বিল ও চান্দামারী বিলকে ঘিরে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার। যারা বৃটিশ আমল থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। মাছের উপর র্নিভরশীল এসব মাঝি পরিবার এখন পেশী শক্তির কাছে তাদের পেশা হারাতে বসেছে।

রাজারহাট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাপাডাঙ্গা গ্রামের অনিমেষ ও মহসিন জানায়, বিলের উপরে এলজিইডি কর্তৃক পাকা সড়ক করা হয়েছে। যারা জমি দখলে রেখেছেন তারাও তীরে পাড় দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে শত শত বিঘা আবাদী জমি জলাবদ্ধতায় চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। এখানে ২২ থেকে ২৫টি পরিবারের জন্য শত শত কৃষক চোখের জল ফেলছে। আমাদের আন্দোলন বিলকে পুর্বাবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়া হোক। এটা নদী নয়। জোড় করে এটিকে নদী বানানো যাবে না।

এদিকে গত ২০২১ সালের ২ ও ৩ নভেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পরিকল্পনা ও মনিটরিং বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মো. মতলুবুর রহমানকে আহবায়ক এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সহকারি প্রধান মো. মাহমুদুল হাসানকে সদস্য সচিব এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পানি বিশেষজ্ঞ মো. সাজিদুর রহমান, কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সদস্য করে চাকিরপশার নদী না বিল এ নিয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি সরজমিনে তদন্ত করেন। এসময় কমিটির সঙ্গে ছিলেন কুড়িগ্রাম এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, রাজারহাটের উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার এবং রাজারহাটের ভূমি কর্মকর্তা। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের সাথে বৈঠকের সময় এই কমিটি চাকিরপশার বিলকে নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন চুড়ান্ত করার সময় দ্বিধাবিভক্ত হন। ফলে প্রতিবেদনে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসি ল্যান্ড প্রতিবেদনে স্বাক্ষরদানে বিরত থাকেন। ফলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনটি সর্বজনিন হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ব্যর্থ হলেও তারা ঢাকায় গিয়ে নিজেদের মতামতকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসক ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুড়িগ্রাম অফিসকে প্রেরণ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, নদ বা নদীর যে উপসঙ্গগুলো থাকে সেটি এখানে নেই। এখানে কোন চর পরে না, নদী ভাঙন নেই, পানির প্রবাহ নেই, তীর বা পাড় নেই। ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত তিস্তা নদীর সাথে কোন প্রকার সংযোগ নেই। এখানে শুধুমাত্র বর্ষা মৌসুমে তদন্ত করা হয়েছে, শুকনো মৌসুমে এর অবস্থান নির্ণয় করা হয়নি। কিছুটা তাড়াহুড়ো ছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পরীক্ষা করা হয়নি। ফলে কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে চাকিরপশার বিলের নাম উল্লেখ না করে পার্শ্ববর্তী উলিপুর উপজেলার বুড়ি তিস্তা বিলের নাম উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের অধিগ্রহনকৃত জমির খাজনা দিয়ে আসছে। আমরা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে খাল/নালা হিসেবে গত বছরের ২৪ মে ৫ হাজার ৯১২টাকা খাজনা দিয়েছি। বিল এবং সেচজমি জন্যই রেগুলেটর স্থাপন করা হয়েছে। ফলে এটিকে নদ বা নদী বলার কোন অবকাশ নেই।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাদের চুড়ান্ত রিপোর্টে বলেছেন, গত ১৪/১১/২০২১ তারিখে কমিটি জুম মিটিং-এর মাধ্যমে চুড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরী করা হয়। তৈরীকৃত প্রতিবেদনে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌখিকভাবে জানান যে, প্রেরীত প্রতিবেদনের সাথে কিছু বিষয়ে তাদের মতদ্বৈততা রয়েছে এবং কিছু বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন। পরবর্তীতে মতপার্থক্য দূরীভূত না হওয়ায় সেটিতে আর স্বাক্ষর না হওয়ায় কিছু সুপারিশ দিয়ে চাকিরপশারকে বুড়ি তিস্তার অংশ হিসেবে ধরে এটিকে বিল/নদী হিসেবে চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের রিপোর্টের ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী চাকিরপশার একটি বিল। যা এসএ রেকর্ডে অনেক ব্যক্তির নামে বিল বা দলা শ্রেণি হিসেবে রেকর্ডভূক্ত করা আছে। এছাড়া ১নং খাস খতিয়ানের কৃষি জমি সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী ইজারা প্রদান করা আছে। সিএস জরীপ ও বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে চাকিরপশার বিলের অভ্যন্তরে বুড়ি তিস্তা নদীর কোন অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কথিত বুড়ি তিস্তা যা (উলিপুর উপজেলায় অবস্থিত) রাজারহাট উপজেলায় এই নামে কোন নদী নেই। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ১৯৮০ সালে ব্যক্তির জমি অধিগ্রহন করে একটি খাল খনন করা হয়। যার মাধ্যমে রাজারহাট উপজেলার নিন্মাঞ্চলের পানি নিষ্কাশিত হয়। চাকিরপশার বিলের সাথে বুড়ি তিস্তা নদীর কোন সম্পর্ক নেই।

পরামর্শের জায়গায় তারা চাকিরপশারকে কখনো নদ বা নদী হিসেবে উল্লেখ করেননি। তারা বিলের পানির প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য সড়কগুলোতে সেতু নির্মাণ এবং ব্যক্তি মালিকানায় দখল করা জায়গা রেকর্ড সংশোধনের মাধ্যমে পুকুর পাড় অপসারণ করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিষয়টি নিয়ে রাজারহাট মীর ঈসমাইল হোসেন ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাজেদুর রহমান চাঁদ জানান, ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে ড. তুহিন ওয়াদুদ বালখিল্যতা করছেন। তার নিজের বাপ-দাদারা আগে ইটাকুড়ি বিল ভোগদখল করে আসছিল। তার দাদা সাফাতুল্যাহ প্রেসিডেন্ট (সাবেক চেয়ারম্যান) প্রজাপত্তনের মাধ্যমে ইটাকুড়ি ও চাকিরপশার বিল সংযোগ স্থান ভোগদখল করে নেন। এরপর তার ছেলে অর্থাৎ ড. তুহিন ওয়াদুদের বাবা আব্দুল কুদ্দুছ ডাক্তার সেই জমিগুলো বিক্রি করে দেন।

রাজারহাটের ছাটমল্লিকবেগ গ্রামের আহমদ উল্যাহর ছেলে লেবু মিয়া ও তার চাচাতো ভাই ফারুক মন্ডল জমি কিনেছেন। আরও অনেকেই জমি কিনে নিজ স্বত্বমূলে ভোগদখল করছে। আগে সে আন্দোলন করেনি। এখন তার বাড়ি যেহেতু চাকিরপশার বিলের উজানে। চাকিরপশার বিলের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় তাদের পারিবারিক কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এজন্য প্রশাসনকে জব্দ করতে বিলকে নদী বানাচ্ছেন। নিজেকে সুশীল সমাজের ধারক বাহক হিসেবে পরিচিত করতে তিনি এই হীনচেষ্টা চালাচ্ছেন। যেটা কারো কাম্য নয়।

রাজারহাট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম জানান, জন্মের পর থেকে বিল হিসেবে দেখে আসছি। চাকিরপশার যদি নদী হয় তাহলে চলনবিলকে এরা মহাসাগর হিসেবে দাবী করবে। জেলার বাইরের মানুষের কাছে আমরা হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমাদেরকে বলা হচ্ছে এখানে নাকি নদ-নদী গ্রাস করা হচ্ছে। যেখানে ৪০ দশক থেকে বিল হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে সেখানে কোন বিশেষজ্ঞ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে কাউকে খুশি করার জন্য এই বিলকে নদী বলে গোয়েবলসকে এরা হার মানিয়েছে। বাইরের মানুষ এসে দেখুক চাকিরপশার আসলে নদী না বিল।

পরিবেশবাদী সংগঠন রিভারনাইন পিপলস’র পরিচালক ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, চাকিরপশার একটি প্রাকৃতিক প্রবাহ। এর বর্তমান দৈর্ঘ্য প্রায় ২০ কিলোমিটার। কোথাও চাকিরপশার, কোথাও মরাতিস্তা কোথাও বুড়িতিস্তা নামে পরিচিত। কুড়িগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত বুড়িতিস্তা নদীর উজানের অংশ চাকিরশপার। রাজারহাটের ইটাকুড়ি থেকে উলিপুরের থেতরাইয়ের তিস্তা পর্যন্ত একে বাধাহীন করতে হবে, সিএস নকশা ধরে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে, সাধারণদের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করলে চাকিরপশার বাঁচবে, হাজার হাজার একর জমির জলাবদ্ধতা দূর হবে, জেলেরা জীবিকা ফিরে পাবে, জীববৈচিত্র রক্ষা পাবে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ও রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরে তাসনিম জানান, আমাদের সংগৃহিত রেকর্ডকৃত কাগজপত্র কখনোই বলছে না চাকিরপশার একটি নদ বা নদী। ফলে কমিটির সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করি। বিলের অধিকাংশ জমি বন্দোবস্ত ও ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। তাদেরকে আমি বৈধ কাগজপত্র নিয়ে ডেকেছিলাম। তারা কাগজপত্র দেখিয়েছে। এখন তাদের দাবীকৃত কাগজপত্র যে সঠিক নয় এটি প্রমাণ করতে আমাকে আইনগতভাবে এগুতে হচ্ছে। উচ্ছেদ করতে গেলে আমাকে আইন মেনেই এগুতে হবে। ভুলগুলো সংশোধন করতে হবে। যে প্রক্রিয়াটা চলমান রয়েছে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, সবগুলো অভিযোগ পেয়েছি। পর্যালোচনা করছি। এটি জটিল আকার ধারণ করেছে। সমন্বিতভাবে সমাধান করতে হবে। ইতোমধ্যে চাকিরপশার বিলের ইজারা স্তগিদ করা হয়েছে। বিলগুলো অন্যায়ভাবে ব্যক্তি মালিকানা বলে রেকর্ড করা হয়েছে। গেজেট হয়ে থাকলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুনালে আপীল করা হবে। মামলা করা হবে। যদি না হয়ে থাকে তাহলে জোনাল সেটেলমেন্ট রংপুর জোনে আপত্তি করা হবে। যে কাজগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক অধিকারকে জানাতে ই-মেইল করুন- inbox.odhikar@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড