মো. রেজোয়ান ইসলাম, নীলফামারী
চোখ ধাঁধানো নিয়ন সাইনের আলোয় নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটি ডিগ্রি। ব্যবস্থাপত্র আর ভিজিটিং কার্ডেও ডিগ্রির মতো আলো ছড়াচ্ছে বাংলা বর্ণমালার বর্ণ আর নানান প্রতিষ্ঠানের নাম। শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবতায় ৩৬ বছর বয়সীর ১৭ বছরের অভিজ্ঞতা!
এমন ডাক্তার নামধারীর সাইনবোর্ডের আলো দেখে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিচ্ছেন গরিব-অসহায় রোগী ও রোগীর স্বজনরা। কারও ঘটছে স্বাস্থ্যহানি, কেউ হচ্ছেন প্রতারিত। তাদের সময়-অর্থ তো নষ্ট হচ্ছেই, উল্টো জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও হরহামেশা শোনা যাচ্ছে। এসব জীবন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে সিভিল সার্জন বরাবর অভিযোগ করেন এক ভুক্তভোগী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডোমার পৗর শহরে বড় বড় সাইন বোর্ড সাঁটিয়ে ফেন্সি ডেন্টাল হোমসহ একাধিক ডেন্টাল হোম খুলে দীর্ঘদিন থেকে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট ওমর ফারুক। ডেন্টিস্ট না হয়েও ১৭ বছরের অভিজ্ঞ ডেন্টিস্ট পরিচয়ে বছরের পর বছর উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় এ অপকর্ম চালিয়ে এলেও ডোমার শহরের যুবক বাঁধন ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর আবাসিক চিকিৎসক তপন কুমার রায়কে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি তদন্তে ওমর ফারুক ডেন্টিস্ট না হয়েও চিকিৎসাপত্র দেয়ার প্রমাণ পায়।
বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন না থাকা সত্ত্বেও তিনি ডেন্টিস্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন এবং তার সার্টিফিকেট অনুযায়ী তিনি একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৭ বছরের অভিজ্ঞতার ধুয়া তোলা এ চিকিৎসকের ফেন্সি ডেন্টাল হোমে পাওয়া যায় অব্যবহৃত ডেন্টাল সামগ্রী।
এ দিকে তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৩০ অক্টোবর ডেন্টিস্ট মো. ওমর ফারুক ও তার প্রতিষ্ঠান ফেন্সি ডেন্টাল হোমের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরসহ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করে পত্র প্রেরণ করেন নীলফামারী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের জে এম শাখার সহকারী কমিশনার আসমা-উল-হুসনা। পরে গত ৮ নভেম্বর ডোমার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জান্নাতুল ফেরদৌস হ্যাপি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ফেন্সি ডেন্টাল হোমসহ আরেকটি ডেন্টাল কেয়ারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জরিমানার কয়েকদিন পর (১২ নভেম্বর) থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফেন্সি ডেন্টাল হোমের স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুক ডাক্তার মোহাই মিনুল ইসলাম (ডেন্টাল সার্জন, রংপুর ডেন্টাল কলেজ)-এর নামে ব্যবস্থাপত্র তৈরি করেন। সেই ব্যবস্থাপত্রে তিনি ব্যবহার করে রোগী দেখছে এবং নিজেই স্বাক্ষর করেন।
এ বিষয়ে জানতে দৈনিক অধিকারের পক্ষ থেকে ডাক্তার মোহাই মিনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জরিমানার রেশ কাটতে না কাটতেই ওমর ফারুক পুনরায় ব্যবস্থাপত্রে নিজ নামের পূর্বে ডেন্টিস্ট লিখে রোগী দেখছেন।
বিষয়টি নিয়ে দৈনিক অধিকারের প্রতিবেদক তথ্য সংগ্রহে গেলে ওমর ফারুক কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এছাড়াও তিনি অসৌজন্যমূলক আচরণও করেন। এ সময় তার ভিজিটিং কার্ড ও ব্যবস্থা সরিয়ে রাখেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসা প্রাপ্ত ব্যক্তি জানান, ডা. মো. ওমর ফারুকের ভুল চিকিৎসার খেসারত দিতে হচ্ছে প্রতি মাসে এক-দুবার রংপুরে চিকিৎসা নিয়ে।
ভুক্তভোগী মো. বাঁধন দৈনিক অধিকারকে বলেন, ডোমারের বিভিন্ন টি স্টলে বন্ধুদের সাথে চা আড্ডায় বেশ কিছুদিন যাবৎ ‘দাঁত ব্যথা’ অনুভূতির কথা বলি। কিছুক্ষণ পর এক উঠতি বয়সী যুবক এসে প্রশ্ন করে, আপনি কি দাঁতের ব্যথা থেকে পরিত্রাণ পেতে চান? উত্তর দিতে না দিতেই একটা ভিজিটিং কার্ড হাতে ধরিয়ে দিল। ডাক্তারের বড় বড় ডিগ্রী ও ১৪ বছরের অভিজ্ঞতাসহ নানামুখী গালগল্প শোনায় সেই উঠতি যুবক এবং এক পর্যায়ে, নাছোড়বান্দার মতো ‘ফেন্সী ডেন্টাল হোম’ নিয়ে গেল। সেখানে ডা. মো. ওমর ফারুক সাহেবের সাথে কথা হয়।
তিনি জানান, ব্যথার দাঁত উঠাতে হবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজী হয়ে গেলাম। কিন্তু ব্যথার দাঁত নড়বড়ে অবস্থায় উঠালেও রক্ত বন্ধের ব্যর্থ চেষ্টা প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবত চলে। অতঃপর অবস্থা বেগতিক দেখে ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না পাঠিয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হতে বলে।
ভুক্তভোগী ঐ রোগী ওমর ফারুকের চোখ ধাঁধানো প্রচারণা ও দালাল চক্র এবং তার পাতানো ফাঁদে যেন আর কেউ না পড়ে সে জন্য বিএমডিসির পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
শহরের জনতা ব্যাংক সংলগ্ন ফেন্সী ডেন্টাল হোমের পাশাপাশি দুটি চেম্বারে মো. ওমর ফারুক নিজ নামের শুরুতে ডাক্তার লিখে দীর্ঘদিন যাবৎ সেবার নামে প্রতারণা করে। শুধু তাই নয় চিকিৎসকের সাইনবোর্ড, ব্যবস্থাপত্র (প্যাড, প্রেসক্রিপশন) ও ভিজিটিং কার্ডে “ডেন্টিস মো. ওমর ফারুক এম.ডি.ডি.টি (রংপুর) এল.ডি.সি.এস (ঢাকা) এফ.টি রংপুর ডেন্টাল, মেডিক্যাল কলেজ (ডেন্টাল ইউনিট)। ১৭ বছরের অভিজ্ঞ মুখ ও দন্ত চিকিৎসক। অন্য আরেক ভিজিটিং কার্ডে ডেন্টিস মো. ওমর ফারুক, এম,ডি,ডি,টি (রংপুর), এল,ডি,সি,এস (ঢাকা) এফ,টি,সি, রংপুর ডেন্টাল কলেজ (১৭ বছরের অভিজ্ঞতা মুখ ও দন্ত্য চিকিৎসক) ইত্যাদি লেখা রয়েছে।
যদিও ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে রাতারাতি ফেন্সি ডেন্টাল হোমের সাইন বোর্ড থেকে ডেন্টিস্ট মুছে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বিভিন্ন রাস্তাঘাট বাজারে তার আগের ব্যানার সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে।
এ দিকে ভুয়া ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও চিকিৎসা প্রত্যাশী রোগীদের পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে দালালদের মাধ্যমে চেম্বারে এনে চিকিৎসার নামে হয়রানি অভিযোগ রয়েছে এই ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রায়হান বারী বলেন, ব্যবস্থা নেওয়ার আমরা কেউ না। তবে আমরা এ বিষয়ে একবার প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। আরও প্রতিবেদন রেডি হচ্ছে। সেটা আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠাবো। তারা ব্যবস্থা নিবেন। একদম মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নীলফামারী সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির দৈনিক অধিকারকে বলেন, ফেন্সি ডেন্টাল হোমের স্বত্বাধিকারী ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসককে অবহিত করলে তিনি স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন।
নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া
সম্পাদকীয় কার্যালয়
১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।
যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702
ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড