• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১  |   ৩৪ °সে
  • বেটা ভার্সন
sonargao

রাধাগোবিন্দ চৌধুরী : একটি আদর্শ একটি অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব

  রাকিব হাসনাত, পাবনা

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:১১
রাধাগোবিন্দ চৌধুরী : একটি আদর্শ একটি অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব
রাধাগোবিন্দ চৌধুরী ও চঞ্চল চৌধুরী (ফাইল ছবি)

পণ্ডিত শব্দের আভিধানিক অর্থ যদি হয় বিদ্বান, বিজ্ঞ, জ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞ কিংবা ভাষা বিশারদ তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় প্রয়াত রাধা গোবিন্দ চৌধুরী (দুলাল মাস্টার) একজন বড় মাপের পণ্ডিত ছিলেন। যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছেন কিংবা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তারাই জানেন - কী বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি!

এক দিকে তিনি ছিলেন- সমাজ সচেতন বিচক্ষণ দূরদর্শী একজন সংগঠক অপরদিকে ছিলেন- একজন আদর্শ শিক্ষকও বটে। সর্বোপরি একজন সফল পিতা। তার আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে জয়ন্ত কুমার চৌধুরী ভারতের শিলিগুড়িতে সরকারি চাকরিরত অবস্থায় অবসর নিয়েছেন। মেজো ছেলে অচিন্ত্য চৌধুরী ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। আর ছোট ছেলেকে কে-ই বা না চেনেন। তিনি আমাদের জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।

শিক্ষক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্য। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও নিত্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে তার তথ্যভাণ্ডার ছিল সমৃদ্ধ।

যেমন- কারো জমিজমা মাপার দরকার হলে চলো দুলাল স্যারের কাছে, মাটি কাটার মাপ চাইলে চলো তার কাছে, কারো ওষুধের প্রেসক্রিপশন বুঝতে হলে চলো তার কাছে, পারিবারিক অশান্তি মিটানোর দরকার হলে চলো তার কাছে, সালিশ বৈঠকের দরকার হলে চলো তার কাছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন হলে তার কাছে, যাত্রা নাটকের আয়োজন হলে চলো তার কাছে, মৃত ব্যক্তির সৎকারের দরকার হলেও চলো তার কাছে।

মোট কথা - এমন কোনো বিষয় ছিল না, যার জন্য এলাকাবাসী তার শরণাপন্ন হতো না। তিনিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সকল কাজে সহযোগিতা করতেন। শুধু কি তাই, আচার-আচরণ চলাফেরা আদব-কায়দা ভদ্রতা বুদ্ধিমত্তা- সকল বিষয়েই তার ছিল অনুকরণ করার মতো ব্যক্তিত্ব।

রাধাগোবিন্দ চৌধুরী পাবনা শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের কামারহাট গ্রামে (১৯৩১ আনুমানিক) সনে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ক্ষিতীশ চন্দ্র সাহা। তিনি ১৯৫৩ সনে ঐতিহ্যবাহী বেড়া সরকারি বিপিন বিহারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে এক বছর পরে ১৯৫৫ সনে কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নেয়ার আগে একইসঙ্গে তিনি ইউনিয়ন পরিষদেও সচিব পদে চাকরি করতেন। এক ব্যক্তির এক চাকরির নিয়ম চালু হওয়ার পরে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। এরপর উপজেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ের চাকরি করে ১৯৭৩ সনে কামারহাট প্রাইমারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান।

এরপর ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসের ২০ তারিখে চাকরি থেকে অবসর নেন। অবসর নেওয়ার পরে পার্শ্ববর্তী সৈয়দ আলী খান কিন্ডার গার্ডেনে প্রায় ৮ বছরের মতো শিক্ষকতা করেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে বেশ কয়েকজন ছাত্র ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয়। এ সময় রাধা গোবিন্দ চৌধুরীর ছাত্র ও বর্তমান কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রাহমান বলেন, শিক্ষক হিসেবে তার ব্যবহার খুবই অমায়িক ছিল। সে সময় আমাদের স্কুল ছিল নদীর পাশে একটি ছোট্ট টিনের চালার। সামান্য বৃষ্টি হলেই সবাই ভিজে একাকার হয়ে যেতাম।

বিদ্যালয়ের মাঠের গাছের নিচে বসিয়ে স্যার নিজেই ক্লাস নিতেন। একদম বাড়ির আঙিনায় স্কুলটি।

স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী না আসলেও তিনি সবার আগে এসে বসে থাকতেন। আবার সবার পরে স্কুল থেকে বাড়িতে যেতেন। যেদিন স্কুলে কোনো স্যার আসে নাই সেদিন রাধা গোবিন্দ স্যার নিজেই সব ক্লাস নিতেন। স্যারের কথা এখনো আমি ভুলতে পারছি না। কারণ স্যারের বাড়ির পাশেই স্কুলটি হওয়ায় পাবনা থেকে ডিসি-এসপি ইউএনও বা ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা আসেন তাহলে চঞ্চল চৌধুরীর বাবাকে ডাকতে বলতেন। তিনি স্কুলে আসলে সম্মানার্থে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসার অনুরোধ জানালেও তিনি বলতেন এ চেয়ার এখন তোমার সুতরাং আমি বসতে পারব না। স্যার যতক্ষণ থাকতেন আমি আমার চেয়ারে বসিনি। তার মতো গুণী মানুষ কালেভদ্রে জন্মে। আমার সৌভাগ্য ছাত্র হিসেবে তার সান্নিধ্য পেয়েছি।

আরেক ছাত্র খোন্দকার হুমায়ুন কবির বলেন, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ছাড়াও স্যারের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। স্যার আর আমার বাবার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। স্যার দীর্ঘদিন কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার বাবা ছিলেন ঐ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। তার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে অনেকেই আমার ভাইবোনদের সহপাঠী।

এ জন্য পারিবারিক সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্যারের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়া ছিল আমাদের রুটিন কাজ।

তিনি আরও বলেন, ছোটবেলায় স্যারকে খুব ভয় পেতাম। স্যার যদি কোথাও থাকতেন তাহলে আমরা পারতপক্ষে ঐখান দিয়ে যেতাম না। অন্য পথে ঘুরে যেতাম। অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। শেষ বয়সে তো স্যার নিজেই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতেন। ভেতরে ভেতরে সংকোচ লাগলেও মনে মনে গর্ব অনুভব করতাম।

তিনি আরও বলেন, মনের মধ্যে আজকে অনেকটা শূন্যতা অনুভব করছি এই ভেবে যে- গ্রামে গেলে শতবর্ষী স্যারের সাথে আর দেখা হবে না। আমাদের পুকুরে স্যার আর কোনো দিন গোসল করতে আসবেন না। স্যারের পবিত্র আত্মা পরপারে শান্তিতে থাকবে। ওপারে বসে যদি তিনি দেখেন তার আলোয় আমরা আলোকিত হয়েছি, তাহলেই তিনি খুশি হবেন।

আব্দুল আজিজ মণ্ডল নামে আরেকজন ছাত্র বলেন, নদী পারে স্কুল হওয়ায় স্কুলে আসতে ভয় পাবো বলে স্যার আমাকে নিজে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। স্কুল ছুটি হলে আবার বাড়িতে রেখে আসতেন। ভালোবাসা মায়া-মমতা দিয়ে আমাদের পাঠদান করিয়েছেন। ক্লাসে খুব ভালো করে বুঝাতেন। স্যার সব বিষয়েই পারদর্শী ছিলেন। তার মধ্যে বাংলা অংক বেশি দক্ষ ছিল। এমনভাবে অংক বুঝাতেন যে খুব সহজেই আমরা বুঝে যেতাম।

তিনি বলেছেন, স্যার কর্মজীবনে যেমন ছিলেন তার চেয়ে সামাজিক জীবনে আরও বেশি মহানুভবতাশীল ছিলেন। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে তিনি সবার আগে গিয়ে কর্ম সম্পাদন করেছেন। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তিনি তার সৎকাজ করতেন।

চঞ্চলের বাল্য বন্ধু তোফাজ্জল হোসেন তোফা বলেন, তিনি আমার একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। চঞ্চলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াতে তাদের সবার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমরা বাড়িতে গেলে নিজেই ঘর থেকে সবকিছু বের করে খাওয়াতেন। আমাদের সঙ্গে খোশ গল্পও করতেন। বাবার মতো করে সবার সঙ্গে ব্যবহার করতেন।

মোটকথা ভালোবাসা স্নেহ দিয়ে সব সময় আগলে রাখতেন। তার আশিস যেন আজীবন শিরে ধারণ করতে পারি। আমরা আপনার মতো মানুষ হতে চাই। আমাদের এলাকায় প্রতি বছর তিনদিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেখানে তিনি বই পড়ে পড়ে আমাদের নিক নির্দেশনা দিতেন। তিনি এলাকার মানুষজনকে সাংস্কৃতিক চর্চারও গুরু ছিলেন। তার থেকে অনেক মানুষ অভিনয় শিখেছে।

মাসুদুর রহমান নামে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বলেন, আমি রাধা গোবিন্দ স্যারের ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা-মাও তার শিক্ষার্থী ছিলেন। স্যারের আদর্শ পেয়েই আজ আমরা ভালো পথ পেয়েছি। তার কথা কোনো দিন ভুলতে পারব না। তার আচার আচরণে মুগ্ধ হয়ে যেতাম।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শহিদুর রহমান খান বলেন, আমাদের এলাকায় শিক্ষার আলো তিনি ছড়িয়েছিলেন। তিনি আমাদের এলাকাকে নিরক্ষরমুক্ত করেছেন। এলাকার এমন কোনো বাড়ি নেই তার দুই/তিন জন করে ছাত্র নেই। অনেক ছাত্র দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন।

তিনি আমাদের এলাকার একজন বাতিঘর ছিলেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় হেরিক্যান জ্বালিয়ে তিনি আমাদের বাড়িতে যেতেন যে ঠিকভাবে পড়াশুনা করছে কিনা। এলাকার আর্থ সামাজিক উন্নয়নে স্যার ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।

রাধা গোবিন্দ চৌধুরীর সহকর্মী কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক কোরবান আলী বলেন, তিনি অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। সব বিষয়ে তিনি সমুদ্রের মত বিশালতার মতো জ্ঞান রাখতেন। সেই সময়ে মেট্রিকুলেশন পাশ করলেও সব দিকের এমন জ্ঞান ছিল যে মনে হতো তিনি একজন বিজ্ঞানী। সহকর্মী হিসেবে তিনি আমাদের সঙ্গে অমায়িক ব্যবহার করতেন। আমাদের যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে আমরা স্কুল পরিচালনা করেছি। আমরা তার থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাহী সম্পাদক: গোলাম যাকারিয়া

 

সম্পাদকীয় কার্যালয় 

১৪৭/ডি, গ্রীন রোড, ঢাকা-১২১৫।

যোগাযোগ: 02-48118243, +8801907484702 

ই-মেইল: inbox.odhikar@gmail.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed by : অধিকার মিডিয়া লিমিটেড